সম্পাদনা ও প্রকাশনা: ফাহাদ কবীর, তরুণ বার্তা।
মুর্শিদাবাদের সদর শহর বহরমপুর থেকে ইসলামপুর – রাণীনগর হয়ে আরেকটু উত্তরে এগোলেই কাতলামারি – কাহারপাড়া এলাকা। ঝকঝকে দিনের স্নিগ্ধ বিকেলে বি. এস.এফ. রাস্তায় এসে বা ব্রিজে দাঁড়িয়ে উত্তরের প্রান্তরে চোখ ফেললেই গাছগাছালির মাথার ওপর উঁকি মারবে বিশাল বিশাল ঝাপসা অট্টালিকা। ওটাই রাজশাহী শহর, বাংলাদেশের সবুজ নগরী বা রেশম নগরী। মুর্শিদাবাদের উত্তর-পূর্ব দিক দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রমত্তা পদ্মা এখানে মুর্শিদাবাদ ও রাজশাহী অর্থাৎ ভারত-বাংলাদেশের সীমানা ভাগ করে দিয়েছে। ইতিহাসের সাক্ষ্য বহনকারী এ অঞ্চলের কুঠিপাড়াতে এখনো মাথা উঁচু করে ভগ্নদশায় দাঁড়িয়ে আছে ইংরেজ আমলের নীলকুঠি।
নদী মানেই জনপদ, নদী মানেই সভ্যতা, নদী মানেই পুরোনো দিনের ইতিহাস। মূল পদ্মা এখানে রাজশাহী শহর ঘেঁষে বয়ে গেছে। পদ্মার একটি শাখা কাহারপাড়া এলাকা দিয়ে প্রবাহিত হয়, স্থানীয়রা বলেন ‘কিচনিদহ’, এই দহের পাশেই রয়েছে দরগাতলা। বর্তমানে, এখানে বহু হিন্দু মানুষজনও তাদের শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে আসেন। এই দরগার রয়েছে সুপ্রাচীন ইতিহাস। এ বাংলায় যার হাত ধরে বরেন্দ্র ও গৌড় অঞ্চলে ইসলামে দীক্ষিত হয়েছিল লাখ লাখ মানুষ তাঁরই একটি খানকা ছিল এটি। তাঁর মূল খানকা বা মাজারটি এই খানকার সোজাসুজি পদ্মার পাশে রাজশাহীতে রয়েছে, মাত্র কয়েক কিমি দূরে।
সুফি সাধক পীর শাহ মখদুম রুপোশ (রহ.)। তিনি হযরত আলীর (রা.) বংশধর এবং মহান পীর আব্দুল কাদের জিলানীর (রহ.) পৌত্র। সুফি সাধক মখদুম (রহ.)-এর পদ্মা নদী বিধৌত অঞ্চলে আগমন, বসবাস আর ধর্মীয় প্রচার তৎকালীন ধর্মীয় সংস্কৃতির আমূল পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হয়েছিল।
শাহ মখদুম (রাহ.) ( ১২১৬-১৩১৩ খ্রিস্টাব্দ) পীরের জন্ম এবং কোরান, হাদিস, সুফিতত্ত্ব, ব্যাকরণ ইত্যাদি বিষয়ের জ্ঞানলাভ হয় বাগদাদ শহরে। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল আব্দুল কুদ্দুস। তাতারীদের হাতে বাগদাদ শহরের পতন ঘটলে পিতা আযাল্লাহ শাহের (রহ.) সাথে তিনি ভারতে আসেন। ভারতে তখন সুলতানি যুগ। প্রখর প্রতিভাবান কুদ্দস সাহেব বাকি শিক্ষা যথেষ্ট উদ্যমের সাথে সম্পন্ন করেন। তখনই তার উপাধি দেওয়া হয় মখদুম, যার অর্থ – সম্মানিত, শিক্ষক বা জ্ঞানী।
দিল্লীর সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবন ১২৭৮ সালে বাংলার বিদ্রোহী শাসক তুঘরিল খানকে শায়েস্তা করতে বাংলায় এলে তার সাথে বহু অনুগামী নিয়ে মখদুম সাহেবরাও তিন ভাই বাংলায় আসেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল এ অঞ্চলে ইসলামের বাণী পৌঁছে দেওয়া। গিয়াসউদ্দিন বলবন তুঘরিল খানকে পরাজিত ও উৎখাত করে বোখরা খানকে দায়িত্বভার দিয়ে যান। তিনি ধর্মপ্রচারকদের খুবই সম্মান করতেন, শাহ মখদুম (রহ.) এর সঙ্গেও তার সখ্যতা তৈরি হয়। তখন থেকেই শাহ মখদুম (রহ.) গৌড়ে বসবাস শুরু করেন। তিনি প্রথমে নোয়াখালী অঞ্চলে ধর্মপ্রচার শুরু করেন ,তারপর বর্তমান রাজশাহী অঞ্চলে আসেন। এই অঞ্চলটি সন্নিহিত আরো কিছু এলাকা নিয়ে তখন মহাকালগড় নামে পরিচিত ছিল। সামন্তরাজ কাপলিক তন্ত্রে বিশ্বাসী দুই ভাই আংশুদেও খেজ্জুর চান্দভন্ডীও বর্মভোজ ও আংশুদেও খেজ্জুর চান্দখড়্গ গুজ্জভোজ এ অঞ্চলে শাসন চালাতেন। তাদের অত্যাচারে সাধারণ হিন্দু জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। এছাড়া তাদের নরবলি দেওয়ার ঘৃণ্য প্রথার বিরুদ্ধেও মানুষজন প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। সর্বোপরি, এ অঞ্চলের মানুষ এই শাসনব্যবস্থা থেকে পরিত্রাণ চাইছিলেন।
এদিকে মখদুম ( রহ. ) সাহেবের সংস্পর্শে অনেকেই ইসলাম ধর্মের পাঠ নিয়েছেন। মখদুম (রহ.) সাহেব সব কিছুই গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করছিলেন। শাসকের দুর্বলতা আর মানুষের সমর্থন নিয়ে তিনি বিশাল বাহিনী তৈরি করেন, তাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে শক্তিশালী করে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। দীর্ঘকাল ধরে চলমান একাধিক যুদ্ধ শেষে দেওরাজরা হার স্বীকার করতে বাধ্য হন। ছয় রাজপুত্রসহ দুজন শাসককে বন্দি করা হয়। কিন্তু, শাহ মখদুম ( রহ.) তাদের হত্যা না করে মুক্ত করে দেন এবং রাজকুমারদের সেবা শুশ্রূষা করে তাদের সুস্থ করে তোলেন। তাঁর এই মহানুভবতা দেওরাজদের মনকে বিগলিত করে এবং মখদুম সাহেবের হাতে তারা ইসলামের দীক্ষা নেন। বলাই বাহুল্য, এরপর এই সুফি সাধকের নেতৃত্বে ইসলামের বিশাল প্রসার ঘটতে থাকলো।
শাহ মখদুম (রহ.) তার প্রধান খানকাটি রাজশাহীতে স্থাপন করেন এবং বেশ কিছু খানকা পদ্মা নদীর আশেপাশের অঞ্চলগুলিতে স্থাপন করেন। এগুলোতে ধর্মীয় শিক্ষা, নৈতিক শিক্ষা, জ্ঞান এবং বঞ্চনার বিরুদ্ধে বিভিন্ন পাঠ, সামাজিক শিক্ষা ইত্যাদি প্রদান করা হতো। তিনি আমৃত্যু ৪৪ বছর এখানে ধর্ম প্রচার করেছিলেন। এই সুফি সাধকের ব্যক্তিত্ব, গুণাবলি, সাধারণ জীবন যাপন, শিক্ষা প্রদানের সরলতা প্রভৃতি মানুষকে ব্যাপকভাবে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করেছিল।
তাঁর জনপ্রিয়তা এতটাই ছিল যে ৭০০ বছর পরে আজও পদ্মাপাড়ের অঞ্চলের মানুষের মুখে তাঁর কিছু অলৌকিক ঘটনা প্রচলিত আছে। তার ভেতর- কুমিরের পিঠে চেপে তাঁর নদী যাত্রার কথা বা বাঘ বন্দী করার অলৌকিক ক্ষমতার কথা উল্লেখযোগ্য। তাঁর মৃত্যুর সাল নিয়ে কিছুটা মতপার্থক্য রয়েছে। তবে যাইহোক, তার কবর বা মাজারটি রাজশাহীতে পদ্মার কাছেই রয়েছে। সেখানেই তার বাহন কুমিরটিকেও সমাধিস্থ করা হয়েছিল, সে কবরটিও এখন বর্তমান। যদিও কুমিরের ঘটনাটি জনশ্রুতি বলেই অনেকে মনে করেন। প্রতি বছর রজব মাসের ২৭ তারিখ শাহ মখদুম রূপোশের (রহ.) মাজারে ওরস পালন করা হয়। লক্ষাধিক ভক্তের সমাবেশ ঘটে প্রতি বছর। তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে রাজশাহীর বিমান বন্দরটির নাম করণ শাহ মখদুম বিমান বন্দর রাখা হয়েছে। এছাড়াও, তাঁর নামে বহু গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের নামকরণ হয়েছে।
ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষার্ধে এবং চতুর্দশ শতাব্দীর শুরুতে বঙ্গে ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে তাঁর নামটি চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তিনি যে অঞ্চল জুড়ে ইসলামের প্রচার করে গেছেন সেসব অঞ্চল আজও মুসলিম অধ্যুষিত। তবে, দেশভাগের পর পদ্মা রাজশাহী থেকে মুর্শিদাবাদকে আলাদা করে দিলেও পদ্মা পাড়ের মানুষজন আজও শাহ মখদুম (রহ.)-কে স্মরণ করে থাকেন। কথিত আছে, কাহারপাড়ার নিকট যে খানকাটি রয়েছে তার বর্তমান অবস্থান এটি নয়। ভাঙনের ফলে মূল জায়গা থেকে বিচ্যুত হয়েছে।
খানকাটি পাকা করা হয়েছে। আজও এটি দরগাতলা হিসেবেই পরিচিত। অনেকেই মনস্কামনা পূরণের উদ্দেশ্যে মানুষকে সিন্নি খাইয়ে থাকেন। তবে, আসল ইতিহাস সম্পর্কে খুব কম জনই ওয়াকিবহাল আছেন। যেগুলো ইসলামের দৃষ্টিতে ঘৃণ্য সেগুলিকে বর্জন করে প্রকৃত পীর বা দরবেশের মাহাত্ম্য তুলে ধরলে বর্তমান প্রজন্ম সমৃদ্ধ হবে। কখনো সময় হলে একবার মুর্শিদাবাদের এ অঞ্চল ঘুরতে পারেন। সীমান্তের ধারে কোলাহলমুক্ত পরিবেশে, কিচনিদহের হাঁটুজল, লোহার ব্রিজ, সবুজ কৃষিক্ষেত্র, প্রান্তর, একটু এগিয়ে পদ্মার পশ্চিম পাড়ে দাঁড়িয়ে বা দরগাতলার পাশে বসে সূর্যাস্তের সময় রাজশাহীর দিকে তাকিয়ে আপনিও শাহ মখদুম (রহ.) সাহবের ঘটনাগুলো মনের চোখে কল্পনায় উপলব্ধি করতেই পারেন।
পদ্মার ওপারে শাহ মখদুম (রহ.) সাহেব তার যথাযোগ্য সম্মান পেয়ে থাকলেও এপারে সময়ের সাথে সাথে গৌরবের ইতিহাস অনেকখানি ফিকে হয়ে গেছে। এখানে এসে সেই সুলতানি আমলে মখদুম (রহ.) দরবেশের কথা ভাবতে ভাবতে আপনার মনে হবে, আজকে যখন এ দেশে মুসলিমরা ছোটখাটো মতবিরোধ নিয়ে নিজেদের মধ্যে উপগোষ্ঠী তৈরি করছে তখন সাত শতাব্দী পূর্বে এ দেশে সুফি সাধকরা নিজদের জীবন উৎসর্গ করে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন – সে কাজে সফল হওয়া কি মুখের কথা ছিল!
লেখক: ফাহাদ কবীর,
তরুণ বার্তার অভিজ্ঞ কন্টেন্ট রাইটার।তার অন্যান্য রচনাসমূহ দেখতে এখানে ক্লিক করুন - ফাহাদ কবীর।

1 Comment
Well written. Keep it up✨