এক গানে তিন দলের তিন ঘোষকে নিয়ে কটাক্ষ, সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে বিতর্কের ঝড়
পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে এবার নতুন মাত্রা যোগ করেছে একটি গান। অভিনেতা অনির্বাণ ভট্টাচার্যের নেতৃত্বাধীন ‘Hooliganism’ ব্যান্ডের ‘তুমি মস্তি করবে জানি’ গানটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হতেই রাজনৈতিক মহলে তোলপাড় শুরু হয়েছে। গানটিতে রাজ্যের তিনটি প্রধান রাজনৈতিক দলের তিন ঘোষকে নিয়ে স্যাটায়ার করা হয়েছে, যা একদিকে প্রশংসা পেলেও অন্যদিকে আইনি জটিলতার মুখে পড়েছে।
গানের বিষয়বস্তু ও রাজনৈতিক কটাক্ষ
গত ৩১ আগস্ট কলকাতার বিশ্ববাংলা মেলা প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত ‘ব্যান্ডস্টর্ম ২০২৫’ কনসার্টে পরিবেশিত এই ৯ মিনিটের গানটি প্রধানত তিন রাজনৈতিক নেতাকে কেন্দ্র করে রচিত। তৃণমূল কংগ্রেসের কুণাল ঘোষ, বিজেপির দিলীপ ঘোষ এবং সিপিএমের শতরূপ ঘোষ – এই তিন ‘ঘোষ’কে নিয়ে গানে নানা ধরনের রাজনৈতিক ও সামাজিক ইস্যু তুলে ধরা হয়েছে।
গানের শুরুতেই অনির্বাণ গেয়ে ওঠেন:
“এসব গান-বাজনা ছাড়, চল প্রোমোটারি করি, বড় গাড়ি চড়ি
ইলেকশনের মেজাজ বুঝে দলটা বদল করি
এই আমাদের দোষ
গানবাজনা করতে এসে এসব কথা বললে
রেগে যাবে কুণাল ঘোষ”

নেতাদের প্রতিক্রিয়া: মিশ্র সাড়া
আশ্চর্যজনকভাবে, গানে উল্লিখিত রাজনৈতিক নেতাদের প্রতিক্রিয়া ছিল বেশ সহনশীল। তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ ফেসবুকে একটি ভিডিও বার্তায় বলেন:
“আমি কেন রাগ করব? বরং মজাই পেয়েছি। এই স্টাইলের গান শুনে ভালোই লাগল। ভালো থেকো অনির্বাণ।”
একইভাবে সিপিএমের শতরূপ ঘোষও মন্তব্য করেন:
“আমি খুশি যে আমি ওই গানের একটি চরিত্র ছিলাম। শুনে ভালোই লাগল।”
তবে বিজেপির প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের কাছে যোগাযোগের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।
বিজেপি নেতার অভিযোগ ও আইনি জটিলতা
গানটি নিয়ে সবচেয়ে বড় বিতর্কের সূত্রপাত করেছেন বিজেপি নেতা ও আইনজীবী তরুণজ্যোতি তেওয়ারি। তিনি কলকাতা পুলিশের সাইবার বিভাগে অনির্বাণ ভট্টাচার্য ও তার ব্যান্ড ‘হুলিগানিজম’-এর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছেন।
- গানটিতে সনাতন ধর্মকে ইচ্ছাকৃতভাবে অপমান করা হয়েছে
- ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা হয়েছে
- এটি সস্তা প্রচারণার জন্য করা হয়েছে
- ভারতীয় দণ্ডবিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হোক
তিনি হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যে পুলিশ যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে তিনি উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হবেন।

গানের ব্যাপক বিষয়বস্তু
‘তুমি মস্তি করবে জানি’ গানটি শুধু তিন ঘোষকে নিয়েই সীমাবদ্ধ নেই। এতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে:
- প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ‘আচ্ছে দিন’ প্রতিশ্রুতি
- বিশেষ নিবিড় সংশোধন (এসআইআর) প্রক্রিয়া
- আরজি কর মেডিকেল কলেজের ঘটনা
- সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা
- দলবদলের রাজনীতি
- ধর্মীয় কাঠামো নিয়ে বিতর্ক
দিলীপ ঘোষের ‘গরুর দুধে সোনা’ মন্তব্য নিয়ে গানে বলা হয়েছে: “গয়না দোকান সব তুলে দাও, গরুর দুধে সোনা”।
অনির্বাণ ভট্টাচার্য: শিল্পী থেকে সক্রিয়তাবাদী
অনির্বাণ ভট্টাচার্য বাংলা থিয়েটার ও সিনেমার একজি প্রতিষ্ঠিত নাম। ‘মিসেস চ্যাটার্জি বনাম নরওয়ে’ এবং ‘দশম অবতার’-এর মতো চলচ্চিত্রে তার অভিনয়ের জন্য তিনি পরিচিত। সম্প্রতি ফেডারেশনের সাথে বিরোধের কারণে তিনি অভিনয় থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখেছেন এবং সঙ্গীতের মাধ্যমে তার মতামত প্রকাশ করছেন।

‘হুলিগানিজম’ ব্যান্ডের গঠন
অনির্বাণের নেতৃত্বে গঠিত ‘হুলিগানিজম’ ব্যান্ডের সদস্যরা হলেন:
- দেবরাজ ভট্টাচার্য
- শুভদীপ গুহ
- কৃষাণু ঘোষ
- সুশ্রুত গোস্বামী
- নীলাংশুক দত্ত
- প্রীতম দাস
- প্রীতম দেব সরকার
- সোমেশ্বর ভট্টাচার্য
এর আগেও ব্যান্ডটির ‘মেলার গান’ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।
সামাজিক মাধ্যমের প্রতিক্রিয়া
সোশ্যাল মিডিয়ায় গানটি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে:
ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া:
- অনেকে একে “বজ্রাঘাত” বলে অভিহিত করেছেন
- রাজনৈতিক সাহসের জন্য প্রশংসা করেছেন
- সৃজনশীল প্রতিবাদের নতুন মাত্রা হিসেবে দেখেছেন
নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া:
- কেউ কেউ একে ‘নিরাপদ বিদ্রোহ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন
- মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধ ও শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাদ দেওয়ার সমালোচনা
- ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগ
শিল্প ও রাজনীতির সম্পর্ক
এই ঘটনা বাংলা সংস্কৃতিতে শিল্প ও রাজনীতির মধ্যে একটি নতুন সংলাপের সূত্রপাত করেছে। একদিকে যেমন শিল্পীদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রশ্ন উঠেছে, অন্যদিকে ধর্মীয় ও সামাজিক সংবেদনশীলতার বিষয়টিও গুরুত্ব পেয়েছে।
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সৌরভ পালোধী মন্তব্য করেছেন:
“বিপ্লব এত সহজ জিনিস নয়। আসলে রাজনৈতিক দায়িত্বই যদি নিতে হয়, যেখানে সিপিএম কেন শূন্য প্রসঙ্গে ওঠে, সেখানে চাকরি বাতিল, স্কুল খুলছে না কেন— এই সব প্রশ্ন করার সাহসও রাখা উচিত।”
আইনি দিক
তেওয়ারির অভিযোগে উল্লেখিত আইনি দিকগুলি:
- ভারতীয় দণ্ডবিধির সংশ্লিষ্ট ধারা
- তথ্য প্রযুক্তি আইন
- ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগ
- সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের চেষ্টা
ভবিষ্যৎ প্রভাব
এই বিতর্ক বাংলা সাংস্কৃতিক জগতে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছে:
- শিল্পীদের মতপ্রকাশের সীমারেখা কতটুকু?
- রাজনৈতিক স্যাটায়ারে ধর্মীয় বিষয়ের অন্তর্ভুক্তি কতটা গ্রহণযোগ্য?
- সামাজিক মাধ্যমের যুগে শিল্পকর্মের দায়বদ্ধতা কেমন হওয়া উচিত?
‘হুলিগানিজম’ ব্যান্ডের এই গানটি শুধু একটি বিনোদনমূলক পরিবেশনা নয়, বরং এটি বাংলার সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হতে পারে। যদিও গানটি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, তবু এটি প্রমাণ করেছে যে সঙ্গীত ও শিল্প এখনও সমাজের আয়না হিসেবে কাজ করতে পারে।
রাজনৈতিক নেতাদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া, জনগণের বৈচিত্র্যময় মতামত এবং আইনি জটিলতার মধ্য দিয়ে এই ঘটনা বাংলার গণতান্ত্রিক পরিবেশের একটি প্রাণবন্ত চিত্র তুলে ধরেছে। ভবিষ্যতে এই ধরনের সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি কীভাবে বিকশিত হয় এবং সমাজে তার স্থান কী হয়, তা দেখার বিষয়।