সূচীপত্র
একটি চমকপ্রদ পরিসংখ্যান দিয়ে শুরু করি – ভারতে বিক্রি হওয়া ৭০% আইফোনই EMI-তে কেনা হয়। আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, এই ক্রেতাদের অধিকাংশই ২৪-৩৫ বছর বয়সী তরুণ-তরুণী। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরা মাসিক বেতনের ৫০% পর্যন্ত ব্যয় করছেন শুধুমাত্র একটি স্মার্টফোনের জন্য। প্রশ্ন হলো – এটা কি শুধুই স্ট্যাটাসের প্রতীক, নাকি একটি গভীর আর্থিক সংকটের সূচনা?
EMI সংস্কৃতি: আধুনিক ভারতের নতুন মহামারী
সাম্প্রতিক গবেষণা অনুযায়ী, ভারতীয় পরিবারগুলোর ৪২% আয় এখন ঋণ পরিশোধে ব্যয় হচ্ছে। আরও ভয়ানক তথ্য হলো, মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর ৩৩% মাসিক বেতন শুধুমাত্র EMI পরিশোধেই শেষ হয়ে যাচ্ছে।
রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, ৫-১০% মধ্যবিত্ত পরিবার ইতিমধ্যে ঋণের ফাঁদে আটকে পড়েছে। বিশেষত তরুণদের মধ্যে ব্যক্তিগত ঋণ গত চার বছরে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে – ৩০.১ লক্ষ কোটি থেকে ৫৯.৫ লক্ষ কোটি টাকা।
আইফোনের প্রতি ভারতীয় যুবসমাজের এই মরিয়া আকর্ষণের পেছনে রয়েছে গভীর মনস্তাত্ত্বিক কারণ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রভাবে তরুণরা বিশ্বাস করছেন যে আইফোন মানেই সফলতার প্রতীক।
একটি সাম্প্রতিক ঘটনায় দেখা গেছে, একজন ব্যক্তি মাসিক ৪০,০০০ টাকা বেতন পেয়েও আইফোন ১৬ প্রো কিনতে মাসিক ২০,০০০ টাকা EMI নিতে রাজি হয়েছিলেন। অর্থাৎ তাঁর আয়ের অর্ধেকটাই চলে যাচ্ছে শুধু একটি ফোনের জন্য।
যুবসমাজের আর্থিক বিপর্যয়: কারণ ও প্রভাব
সামাজিক চাপ এবং FOMO সংস্কৃতি
“Fear of Missing Out” বা FOMO হয়ে উঠেছে আধুনিক তরুণদের অন্যতম বড় সমস্যা। সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে তরুণরা ক্রমাগত অন্যদের সাথে নিজেদের তুলনা করছেন। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ৯৩% ভারতীয় তরুণ-তরুণী ট্রেডিং এবং বিনিয়োগে অর্থ হারাচ্ছেন শুধুমাত্র দ্রুত ধনী হওয়ার আশায়।
শিক্ষার্থীদের ক্রেডিট কার্ড সংস্কৃতি
আরও উদ্বেগজনক বিষয় হলো, ১৮ বছর বয়স থেকেই তরুণরা ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার শুরু করছেন। ব্যাংকগুলো বিশেষভাবে ছাত্রছাত্রীদের জন্য ক্রেডিট কার্ড চালু করেছে, যার ফলে অল্প বয়স থেকেই ঋণের সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে নতুন প্রজন্ম।
স্ট্যাটাস সিম্বল বনাম আর্থিক বুদ্ধিমত্তা
বিশেষজ্ঞরা পরিষ্কারভাবে বলেছেন, ধনী ব্যক্তিরা ঋণ নেন সম্পদ তৈরি করার জন্য, আর মধ্যবিত্তরা ঋণ নেন স্ট্যাটাসের জন্য। একটি আইফোন কেনার সাথে সাথেই এর দাম কমে যায়, কিন্তু EMI কিন্তু ১২-২৪ মাস ধরে চালিয়ে যেতে হয়।
গণিতের হিসাবটা চমকপ্রদ: যদি কেউ আইফোনের জন্য মাসিক ১৫,০০০ টাকা EMI না দিয়ে সেই অর্থ মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করেন, তাহলে ৫ বছরে তার ২.৬ লক্ষ টাকা এবং ১০ বছরে ৪.৬ লক্ষ টাকা হবে। অথচ আইফোনটি ২ বছরেই পুরাতন হয়ে যাবে।
তরুণদের মধ্যে ভোগবাদী সংস্কৃতির বিস্তার
সমাজবিজ্ঞানীরা একে “মেমেটিক ডিজায়ার” বলে অভিহিত করেছেন। অর্থাৎ, তরুণরা অন্যদের দেখাদেখি কিছু কিনছেন, প্রকৃত প্রয়োজন থেকে নয়। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ৮৪% গ্রামীণ পরিবার এবং ৪২% শহুরে পরিবার ইতিমধ্যে ঋণগ্রস্ত।

ঋণের ফাঁদ: মধ্যবিত্তের নতুন দুঃস্বপ্ন
বিশেষজ্ঞ মতামত অনুযায়ী, বর্তমানে ভারতে পারিবারিক ঋণের মোট পরিমাণ ১ ট্রিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ১৬% হলো অনিরাপদ ঋণ (ক্রেডিট কার্ড ও ব্যক্তিগত ঋণ), যার ১০% ইতিমধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে। অর্থাৎ ১৬ বিলিয়ন ডলার ঋণ খেলাপি অবস্থায় রয়েছে।
যুবসমাজের উপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব
আর্থিক বিশেষজ্ঞ সৌরভ মুখার্জীর মতে, কোভিড-পরবর্তী সময়ে মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে তাদের আর্থিক সামর্থ্য যাই হোক না কেন, তারাও বিলাসবহুল জীবনযাত্রার অধিকারী। এই মানসিকতার কারণে তরুণরা ভবিষ্যতের আর্থিক নিরাপত্তার কথা না ভেবেই বর্তমানে খরচ করছেন।
প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর বিপণন কৌশল
আইফোন কোম্পানি তাদের বিপণন কৌশলে “অ্যাফোর্ডেবিলিটি” শব্দটি ব্যবহার করে EMI-র মাধ্যমে একটি বিভ্রম তৈরি করেছে। মাসিক ২,৫০০ টাকা EMI শুনতে সাশ্রয়ী মনে হলেও, মোট খরচ হয় অনেক বেশি। সুদের হিসাব যোগ করলে একটি আইফোনের জন্য ক্রেতাকে প্রায় ২০-৩০% অতিরিক্ত অর্থ দিতে হয়।
ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মের ভূমিকা
অনলাইন শপিং প্ল্যাটফর্মগুলো বিশেষভাবে তরুণদের টার্গেট করে “নো কস্ট EMI” এর নামে বিভ্রান্তিকর অফার দিচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, অনলাইন সেলের ৭৫% পণ্য EMI-তে বিক্রি হচ্ছে।
সমাধানের পথ: কী করা উচিত?
প্রথমেই প্রয়োজন সঠিক আর্থিক শিক্ষা। তরুণদের বুঝতে হবে যে “আমি এটা পেতে পারি” এবং “আমি এটা কিনতে পারি” – এই দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম হলো, EMI যদি মোট আয়ের ৪০% ছাড়িয়ে যায়, তাহলে সেটি ঝুঁকিপূর্ণ।
বিকল্প পথের সন্ধান
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী, তরুণদের উচিত:
- প্রথমে সঞ্চয় করুন, তারপর কিনুন
- পুরাতন মডেল বেছে নিন (আইফোন ১৩/১৪ বরং ১৫ প্রো ম্যাক্সের চেয়ে ভালো)
- জরুরি তহবিল তৈরি করুন কেনাকাটার আগে
- ফোনকে স্ট্যাটাস সিম্বল নয়, একটি যন্ত্র হিসেবে দেখুন
EMI বনাম বিনিয়োগ: গাণিতিক তুলনা
ক্রেডিট কার্ডের সুদের হার ৩৬% পর্যন্ত হতে পারে, অথচ মিউচুয়াল ফান্ডে গড় রিটার্ন ১২%। এই পার্থক্য বুঝলেই স্পষ্ট হয়ে যায় কোনটি বুদ্ধিমানের কাজ।
দীর্ঘমেয়াদী আর্থিক প্রভাব
একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যারা অল্প বয়স থেকে EMI নেওয়া শুরু করেন, তাদের ভবিষ্যতে সম্পদ তৈরির ক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। কারণ তাদের আয়ের একটি বড় অংশ ঋণ পরিশোধেই ব্যয় হয়ে যায়।
সামাজিক দায়বদ্ধতা এবং পারিবারিক ভূমিকা
পিতা-মাতার দায়িত্ব
পরিবারের বয়স্কদের উচিত সন্তানদের আর্থিক শিক্ষায় শিক্ষিত করা। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, পিতা-মাতার আইফোন নেই, কিন্তু সন্তানের আছে – এই পরিস্থিতি স্বাভাবিক নয়।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা
স্কুল-কলেজগুলোতে আর্থিক সাক্ষরতার বিষয়টি বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। কেবল একাডেমিক পড়াশোনা নয়, বাস্তব জীবনের আর্থিক পরিকল্পনাও শেখানো উচিত।
ভারতের তরুণ প্রজন্ম একটি গুরুতর আর্থিক সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে আছে। আইফোনের জন্য EMI নেওয়া শুধু একটি ফোন কেনা নয় – এটি একটি মানসিকতার প্রতিফলন যা দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিকর।
প্রশ্নটা আসলে এই নয় যে আপনি একটি আইফোন কিনতে পারবেন কি না, প্রশ্ন হলো এই কেনাকাটা আপনার আর্থিক ভবিষ্যতের জন্য কতটা ক্ষতিকর। যুগে যুগে মানুষ বলে এসেছে – “যার নেই তার সংসার, তার কি দরকার পরিকার।”
আজকের তরুণদের বুঝতে হবে, স্ট্যাটাস সিম্বল কখনও আর্থিক স্বাধীনতার চেয়ে বড় নয়। EMI-র মায়াজালে পড়ে নিজেদের ভবিষ্যৎ বন্ধক রাখার চেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হবে ধৈর্য ধরে সঞ্চয় করা এবং সামর্থ্য অনুযায়ী খরচ করা।
সময় এসেছে এই EMI সংস্কৃতির বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরি করার – না হলে একটি পুরো প্রজন্ম ঋণের জালে আটকে পড়বে, যা জাতীয় অর্থনীতির জন্যও হুমকিস্বরূপ।
লেখকের মতামত: এই নিবন্ধটি কোনো নির্দিষ্ট ব্র্যান্ড বা পণ্যের বিরুদ্ধে নয়, বরং অদূরদর্শী আর্থিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে একটি সতর্কতামূলক বার্তা।
অবশ্যই পড়ুন : ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ভবিষ্যৎ কোথায়? – তরুণ বার্তা
বর্তমান জনপ্রিয় হওয়া আইফোন ১৭ এর মূল্য: amazon.in তে[T&C]
