রাশিয়ার বিজ্ঞানীরা ইতিহাস তৈরি করেছেন। তাদের উদ্ভাবিত এন্টেরোমিক্স ক্যানসার ভ্যাকসিন প্রাথমিক ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে ১০০% কার্যকারিতা প্রদর্শন করেছে। এই যুগান্তকারী আবিষ্কার বিশ্বব্যাপী ক্যানসার চিকিৎসায় নতুন যুগের সূচনা করতে পারে।
বিপ্লবী ভ্যাকসিন এন্টেরোমিক্স
রাশিয়ার ন্যাশনাল মেডিকেল রিসার্চ রেডিওলজিক্যাল সেন্টার এবং এঙ্গেলহার্ড ইনস্টিটিউট অফ মলিকিউলার বায়োলজি যৌথভাবে এই ভ্যাকসিন তৈরি করেছে। এটি এমআরএনএ প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি – যা কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনেও ব্যবহৃত হয়েছিল।
ভ্যাকসিনটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হলো এটি প্রতিটি রোগীর জন্য ব্যক্তিগতভাবে প্রস্তুত করা হয়। প্রতিটি রোগীর ক্যানসার কোষের জেনেটিক গঠন বিশ্লেষণ করে তার জন্য বিশেষ ভ্যাকসিন তৈরি করা হয়।
কীভাবে কাজ করে এই ভ্যাকসিন
এন্টেরোমিক্স ভ্যাকসিনটি চারটি ক্ষতিকারক ভাইরাস একত্রে ব্যবহার করে। এই ভাইরাসগুলো সরাসরি ক্যানসার কোষগুলোকে আক্রমণ করে ধ্বংস করে। একই সাথে রোগীর ইমিউন সিস্টেমকে সক্রিয় করে তোলে যাতে তা নিজেই ক্যানসার কোষের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে।
এমআরএনএ প্রযুক্তি কোষগুলোকে নির্দেশনা দেয় কীভাবে একটি বিশেষ প্রোটিন তৈরি করতে হয়, যা শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ক্যানসার কোষ চিহ্নিত করতে এবং ধ্বংস করতে সাহায্য করে।
চমৎকার পরীক্ষার ফলাফল
৪৮ জন স্বেচ্ছাসেবকের উপর করা পরীক্ষায় অভাবনীয় ফলাফল পাওয়া গেছে:
- ১০০% কার্যকারিতা এবং নিরাপত্তা প্রমাণিত
- ৬০-৮০% টিউমার সংকোচন দেখা গেছে
- কোন গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই
- রোগীরা ভালোভাবে সহ্য করতে পেরেছেন
- জীবন রক্ষার হার বৃদ্ধি পেয়েছে
ফেডারেল মেডিকেল এন্ড বায়োলজিক্যাল এজেন্সির প্রধান ভেরোনিকা স্কভর্তসোভা জানান, “কয়েক বছরের গবেষণার পর শেষ তিন বছর বাধ্যতামূলক প্রি-ক্লিনিক্যাল স্টাডিতে ব্যয় করা হয়েছে। ভ্যাকসিনটি এখন ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত। আমরা চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় আছি।”
বিশ্বব্যাপী ক্যানসারের ভয়াবহ চিত্র
কোলোরেক্টাল ক্যানসার বিশ্বব্যাপী তৃতীয় সর্বাধিক প্রচলিত ক্যানসার। প্রতি বছর বিশ্বে ১৯ লক্ষ ২৬ হাজারেরও বেশি নতুন রোগী এই ক্যানসারে আক্রান্ত হন এবং ৯ লক্ষ ৩০ হাজারের মতো মানুষ মৃত্যুবরণ করেন।
বিশ্বব্যাপী ক্যানসার ভ্যাকসিন বাজারের মূল্য ২০২৩ সালে ৯.৭০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছিল এবং ২০৩২ সালের মধ্যে তা ১৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে পারে।
ঐতিহ্যগত চিকিৎসার তুলনায় সুবিধা
এন্টেরোমিক্স ভ্যাকসিন কেমোথেরাপি বা রেডিয়েশন এর মতো প্রথাগত চিকিৎসার তুলনায় অনেক উন্নত:
- পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কম – সুস্থ কোষের কোন ক্ষতি হয় না
- লক্ষ্যভেদী চিকিৎসা – শুধু ক্যানসার কোষকে আক্রমণ করে
- ব্যক্তিগত – প্রতিটি রোগীর জন্য আলাদা করে তৈরি
- নিরাপদ – বার বার প্রয়োগ করা যায়
কোন কোন ক্যানসারে কাজ করবে
প্রাথমিকভাবে কোলোরেক্টাল ক্যানসার বা অন্ত্রের ক্যানসারের জন্য এই ভ্যাকসিন ব্যবহার করা হবে।
গবেষকরা আরো বলেছেন যে গ্লায়োব্লাস্টোমা (মস্তিষ্কের আক্রমণাত্মক ক্যানসার) এবং বিশেষ ধরণের মেলানোমা (চোখের ক্যানসার সহ) এর জন্যও ভ্যাকসিন উন্নয়নের কাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত ও সতর্কতা
যদিও এই ফলাফল অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক, তবুও বিশেষজ্ঞরা সতর্ক থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন। ড. ভাটিয়া মন্তব্য করেছেন, “এখনও পর্যন্ত কোনো পিয়ার রিভিউড পাবলিকেশন নেই। যতক্ষণ না আমরা কাঁচা ডেটা, বায়োমার্কার, প্রগ্রেশন-ফ্রি সারভাইভাল রেট এবং ৬-১২ মাসের বেশি সামগ্রিক বেঁচে থাকার হার দেখতে পাই, এটি একটি খুবই আশাব্যঞ্জক কিন্তু অপ্রমাণিত হস্তক্ষেপ হিসেবেই থাকবে।”
এগিয়ে যাওয়ার পথ
পূর্ব অর্থনৈতিক ফোরাম ২০২৫ এ এই ভ্যাকসিনের ঘোষণা করা হয়েছে। রাশিয়ার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এর চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে এন্টেরোমিক্স।
যদি অনুমোদন পায়, তাহলে এটি হবে বিশ্বের প্রথম ব্যক্তিগতকৃত এমআরএনএ ক্যানসার ভ্যাকসিন যা সাধারণ মানুষের জন্য উপলব্ধ হবে।
ভবিষ্যতের সম্ভাবনা
এই ভ্যাকসিনের সাফল্য ক্যানসার চিকিৎসায় এক নতুন যুগের সূচনা করতে পারে। বিশ্বব্যাপী ১২০টিরও বেশি এমআরএনএ ক্যানসার ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলমান রয়েছে।
ব্যক্তিগতকৃত চিকিৎসা এর এই অগ্রগতি ক্যানসারকে একটি নিয়ন্ত্রণযোগ্য রোগে পরিণত করতে পারে, যা লক্ষ লক্ষ রোগীর জন্য নতুন আশার সঞ্চার করবে।
রাশিয়ার এই আবিষ্কার শুধু তাদের দেশেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। সফল হলে এটি বিশ্বব্যাপী অনুরূপ উদ্ভাবনের পথ প্রশস্ত করবে এবং মানবজাতিকে ক্যানসারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হতে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে।