সাহিত্যের দর্পণে সমকালীন সমাজের চিত্র প্রস্ফুটিত হয়, এ চিত্র পাঠকের মানসপটে সময়ের সীমারেখা অতিক্রম করে ভাবাবেগ, মানবিক ছোঁয়া আর কল্পনার উদ্রেক ঘটিয়ে সমাজকে বুঝতে শেখায়, ভাবতে শেখায়। আর ভ্রমণ মানুষকে নতুন সমাজ, নতুন মানুষ, নতুন সংস্কৃতি, বেশভূষা, আদব কায়দা বা নতুন চিন্তাধারা সবকিছুরই সংস্পর্শে নিয়ে আসে। আর এই ভ্রমণ অভিজ্ঞতা যখন সাহিত্যিকের কলমের ছোঁয়াতে সাহিত্য-গুণাবলি অর্জন করে, তা-ই হয়ে ওঠে ভ্রমণ সাহিত্য।
বাংলা ভ্রমণ সাহিত্যের ইতিহাসের বীজ সুদূর চর্যাপদের যুগে নিহিত থাকলেও, ভ্রমণ সাহিত্যের সার্থক আকর গ্রন্থ সাহিত্যের পর্যায়ে উন্নীত হতে বেশ সময় লেগেছে। মূলত এ দেশে ইংরেজরা আসার পরেই বাংলা সাহিত্যিকগণ এ ধারায় সাবলীল ভাবে কলম ধরতে শুরু করেছিলেন। বঙ্গদর্শন পত্রিকায় প্রকাশিত সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পালামৌ’- কেই বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ভ্রমণ কাহিনী বলা চলে। এখানে লেখকের শৈল্পিক দক্ষতার নিপুণ বিবরণে ব্রিটিশ আমলের পালামৌ অঞ্চলের সৌন্দর্যের সাথে, কোল উপজাতির জীবন বর্ণনার গভীর পরিচয় মেলে।
পরবর্তীকালে, বিভূতি ভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আরণ্যক’ উপন্যাসে এ ধরণের, কিন্তু অবশ্যই, ভিন্ন লেখনীশৈলীর পটে বিহারের বনজঙ্গল, সেখানকার মানুষ, ভালোবাসা, বেঁচে থাকা, বন্য জানোয়ার সবকিছুর অপূর্ব মিশ্রণ সম্বলিত মানবিক গুণান্বিত কাহিনী চিরপ্রবাহী শব্দহীন ফল্গুর মতো প্রবাহিত হয়েছে। তার ‘চাঁদের পাহাড়’ বইখানিও এডভেঞ্চার ভ্রমণ কাহিনী হিসেবে উল্লেখ করা যেতেই পারে।
বাংলা ভ্রমণ সাহিত্যের চর্চায় রবীন্দ্রনাথ, সৈয়দ মুজতবা আলী, অন্নদাশঙ্কর রায়, প্রবোধ কুমার সান্যাল প্রমুখের নাম জড়িয়ে আছে। মুজতবা আলীর ‘দেশে বিদেশে’ গ্রন্থটি তৎকালীন ভারত, পাকিস্থান ও আফগানিস্তানের সংস্কৃতির একটি উৎকৃষ্ট ফিউশন। আবার, অন্নদাশঙ্করের ‘পথে প্রবাসে’ বইটিও সার্থক ভ্রমণ সাহিত্যের মর্যাদা পেয়েছে। প্রবোধ কুমার সান্যালের ‘মহাপ্রস্থানের পথে’ বইটি পাঠ করে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র’, ‘য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি’, ‘জাপান-যাত্রী’, ‘রাশিয়ার চিঠি’ ইত্যাদি শীর্ষক ভ্রমণ গ্রন্থ রচনা করে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন।
বলাই বাহুল্য, বাঙালির প্রিয় চরিত্র কাকাবাবু বা ফেলুদার বেশ কিছু অভিযান পাঠকের মনে পরোক্ষে ভ্রমণ সাহিত্যেরই সমতুল্য হয়ে উঠেছে। এর পাশাপাশি, বিভিন্ন ম্যাগাজিনে নতুনরাও অনেক ভ্রমণকাহিনী লিখে আসছেন যেগুলো বিভিন্ন সংখ্যায় প্রকাশিত হয়ে থাকে। তবে যাইহোক, বাংলা ভ্রমণ সাহিত্যের বিশাল ভান্ডার ভ্রমণ পিপাসু বাঙালিকে সাহিত্যের খোরাক জুগিয়ে আসছে বরাবরই। বহু দূরের অজানা জনপদের জীবনপ্রণালী, ভাষা, সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হয়ে পাঠক সমাজ সংকীর্ণতার গণ্ডি অতিক্রম করে পৃথিবীর বিশালতা অনুভব করতে পারে সাহিত্যের পাতায় চোখ রাখতে রাখতেই। গৃহমুখী বাঙালিকে আত্মোপলব্ধি, বিশ্ব অনুসন্ধান ও এডভেঞ্চারের স্বপ্ন দেখাতে অনন্য জায়গা দখল করতে পেরেছিল ভ্রমণ সাহিত্য। বর্তমানে, কালের পরিবর্তনে ভিডিও ভ্লগ এলেও তা কখনোই সাহিত্যের পর্যায়ে পৌঁছাতে পারবে না। আজও বাংলা ভ্রমণ সাহিত্য পাঠক সমাজে সমানভাবে প্রাসঙ্গিক ও সমাদৃত ।
কন্টেন্ট রাইটার: ফাহাদ কবীর।
8 Comments
বাহ্ অসাধারন হয়েছে।
পুরোটা মন দিয়ে পড়লাম খুব সাজানো গোছানো লেখা।
পরীক্ষায় এমন লিখে আসতে পারলে চাকরি কনফার্ম l🔥🔥
ধন্যবাদ। চাকরির পরীক্ষার জন্য উপযোগী হলেও, লেখাটি সব বয়সের সাহিত্যপ্রেমী মানুষ উপভোগ করবেন।
টপিকটা এবারের মিসেলেনিয়াস মেইনসে এসেছিল।
হ্যাঁ। ২০২৩ সালের মেইনস পরীক্ষায় এসেছিল, যেটি ২০২৫ সালে অনুষ্ঠিত হলো।
খুব সুন্দর হয়েছে
ধন্যবাদ আপনাকে।
Asadharon lekhoni
ধন্যবাদ আপনাকে লেখাটি পড়ার জন্য।