ভারতের নতুন জিএসটি ২.০ সংস্কার ২০২৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ভারত সরকার ঘোষিত জিএসটি ২.০ সংস্কার দেশের পরোক্ষ কর ব্যবস্থায় একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে। এই সংস্কার সাধারণ মানুষের জন্য স্বস্তির খবর হলেও রাজনৈতিক মহলে তীব্র বিতর্কের সৃষ্টি করেছে।
নতুন জিএসটি কাঠামো: দুই-স্তরের সরল ব্যবস্থা

সরকার বর্তমান চার-স্তরের জিএসটি ব্যবস্থা (৫%, ১২%, ১৮%, ২৮%) থেকে মূলত দুই-স্তরের ব্যবস্থায় (৫% এবং ১৮%) রূপান্তরিত করেছে। নতুন ব্যবস্থায় একটি বিশেষ ৪০% স্ল্যাব যোগ করা হয়েছে বিলাসবহুল এবং ক্ষতিকর পণ্যের জন্য।
পণ্যভিত্তিক কর পরিবর্তনের বিশ্লেষণ

করমুক্ত পণ্য (০%):
৫% স্ল্যাবে স্থানান্তরিত:
- চুলের তেল, শ্যাম্পু, টয়লেট সাবান (১৮% থেকে ৫%)
- মাখন, ঘি, পনির (১২% থেকে ৫%)
- রান্নাঘরের সামগ্রী, বাঁশের আসবাব
- কৃষি যন্ত্রপাতি, ট্রাক্টর, সেচ সরঞ্জাম
- স্টেশনারি – পেনসিল, চার্ট, নোটবুক
১৮% স্ল্যাবে হ্রাসপ্রাপ্ত:
- এয়ার কন্ডিশনার, টিভি, রেফ্রিজারেটর (২৮% থেকে ১৮%)
- ১২০০ সিসির নিচের ছোট গাড়ি (২৮% থেকে ১৮%)
- ৩৫০ সিসির নিচের মোটরবাইক (২৮% থেকে ১৮%)
- সিমেন্ট (২৮% থেকে ১৮%)
৪০% স্ল্যাবে বৃদ্ধি:
- তামাক পণ্য, সিগারেট, বিড়ি
- চিনিযুক্ত পানীয়, কার্বনেটেড পানীয়
- বিলাসবহুল গাড়ি ও প্রিমিয়াম মোটরবাইক
বিরোধী দলের তীব্র সমালোচনা
কংগ্রেসের অভিযোগ
কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খার্গে এই সংস্কারকে “জিএসটি ১.৫” বলে আখ্যায়িত করে প্রকৃত জিএসটি ২.০ এর জন্য অপেক্ষা চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন। তিনি অভিযোগ করেছেন যে মোদি সরকার “এক জাতি, এক কর” পরিবর্তন করে “এক জাতি, নয় কর” বানিয়েছে।
কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ বলেছেন, “এটি একটি বৃদ্ধি দমনকারী কর হয়ে উঠেছে। রাজ্যগুলির ক্ষতিপূরণের দাবি পূরণ হয়নি।”
প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী পি চিদাম্বরম স্বাগত জানিয়েও বলেছেন, “এই সংস্কার ৮ বছর দেরিতে এসেছে। আমরা ৮ বছর ধরে চিৎকার করে বলে আসছি কিন্তু আমাদের আবেদন কানে নেওয়া হয়নি।”
আঞ্চলিক দলগুলির প্রতিক্রিয়া
কর্ণাটকে দ্বিধাদ্বন্দ্ব: কংগ্রেস-শাসিত কর্ণাটক সরকার দ্বিধায় পড়েছে। রাজ্যের মন্ত্রীরা বলছেন বার্ষিক ১৫,০০০ কোটি টাকা ক্ষতি হবে, কিন্তু অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন এটি সামলানো যাবে।
সমাজবাদী পার্টি: মুখপাত্র ফখরুল হাসান চাঁদ প্রশ্ন তুলেছেন, “আটার দাম কত? তেল আর চালের দাম কত? শ্যাম্পু দিয়ে পেট ভরে নাকি? পেট্রোল-ডিজেল কখন জিএসটির আওতায় আসবে?”
সরকারের পাল্টা জবাব
অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামণ বিরোধীদের সমালোচনার জোরালো জবাব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “বিরোধীরা বলছে আমরা প্রথমে উচ্চ হার দিয়েছি এখন কমাচ্ছি। কিন্তু এই হারগুলো আমরা নির্বিচারে নির্ধারণ করিনি, এগুলো পূর্ববর্তী ব্যবস্থা থেকে এসেছে।”
তিনি আরও বলেছেন, “এক আঙুল তুললে তিনটি আঙুল নিজের দিকে ফিরে আসে। বলুন তো, ৭০ বছরে কেন এটি বাস্তবায়ন করতে পারলেন না?”
বিহার নিয়ে বিতর্ক
কংগ্রেসের কেরালা শাখার একটি সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট বিহারে তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। পোস্টটিতে বিড়ির জিএসটি হ্রাস এবং বিহারের মধ্যে সংযোগ করে “বিড়ি এবং বিহার দুটিই বি দিয়ে শুরু” লেখা হয়েছিল। পরে এই পোস্ট মুছে ফেলা হয়।
বিজেপি নেতারা এটিকে বিহারের অবমাননা বলে তীব্র সমালোচনা করেছেন। উপমুখ্যমন্ত্রী সামরাট চৌধুরী বলেছেন, “প্রথমে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে অপমান করা হয়েছে। এখন পুরো বিহারকে অপমান করা হয়েছে।”
অর্থনৈতিক খাতে প্রভাব
যে খাতগুলি সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে
ভোগ্যপণ্য খাত (FMCG): ব্রিটানিয়া, নেসলে, কোলগেট, ডাবর, তাতা কনজিউমার প্রোডাক্টস এর মতো কোম্পানিগুলি বিশেষভাবে লাভবান হবে কারণ তাদের পণ্যের কর হার কমেছে।
খুচরা বিক্রয় খাত: ট্রেন্ট, আদিত্য বিড়লা ফ্যাশন, গো ফ্যাশনের মতো কোম্পানিগুলি বর্ধিত ভোক্তা চাহিদার সুবিধা পাবে।
গৃহস্থালী যন্ত্রপাতি: এসি, টিভি, রেফ্রিজারেটরের কর কমায় হোয়ারপুল, এলজি, স্যামসাং এর মতো কোম্পানি উপকৃত হবে।
অটোমোবাইল: ছোট গাড়ি ও মোটরবাইকের কর হ্রাসে মারুতি, হুন্ডাই, টাটা মোটরস, বাজাজ অটো, হিরো মোটোকর্প উপকৃত হবে।
নির্মাণ খাত: সিমেন্টের কর কমায় আল্ট্রাটেক, অ্যাক্স সিমেন্ট, শ্রী সিমেন্ট, রামকো সিমেন্ট লাভবান হবে।
যে খাতগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হবে
তামাক শিল্প: ২৮% থেকে ৪০% কর বৃদ্ধিতে আইটিসি এর মতো কোম্পানির বিক্রয় কমতে পারে।
পানীয় শিল্প: চিনিযুক্ত ও কার্বনেটেড পানীয়ের ৪০% কর কোকা-কোলা, পেপসিকোর মতো কোম্পানিকে প্রভাবিত করবে।
সাধারণ মানুষের জন্য সুবিধা
মাসিক সাশ্রয়: বিশেষজ্ঞরা অনুমান করছেন যে একটি মধ্যবিত্ত পরিবার মাসিক ২,০০০-৩,০০০ টাকা সাশ্রয় করতে পারবে।
মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস: জিএসটি ২.০ মুদ্রাস্ফীতি ১.১ শতাংশ পয়েন্ট পর্যন্ত কমাতে পারে বলে প্রত্যাশা।
ভোগ বৃদ্ধি: শহুরে পরিবারগুলি ৭-৮% এবং গ্রামীণ পরিবারগুলি ৫-৬% সাশ্রয় করবে।
রাজ্যগুলির আর্থিক চিন্তা
রাজস্ব ক্ষতির আশঙ্কা: কংগ্রেস-শাসিত রাজ্যগুলি বিশেষত কর্ণাটক, কেরালা, তেলেঙ্গানা রাজস্ব ক্ষতির আশঙ্কা প্রকাশ করেছে।
ক্ষতিপূরণের দাবি: বিরোধী-শাসিত রাজ্যগুলি আরও পাঁচ বছরের জন্য GST ক্ষতিপূরণ বৃদ্ধির দাবি জানিয়েছে।
শিল্প জগতের প্রতিক্রিয়া
ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া: রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের মুকেশ আম্বানি এই সংস্কারকে “দ্বিতীয় প্রজন্মের জিএসটি সংস্কার” বলে স্বাগত জানিয়েছেন।
CII ও FICCI: শিল্প সংগঠনগুলি এই সংস্কারকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য ইতিবাচক বলে মন্তব্য করেছে।
দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ও প্রত্যাশা
জিডিপি প্রবৃদ্ধি: অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধির ফলে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে ০.৩-০.৫ শতাংশ পয়েন্ট ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
কর্মসংস্থান সৃষ্টি: ভোগ্যপণ্য ও সেবা খাতের সম্প্রসারণে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
রপ্তানি বৃদ্ধি: কৃষি পণ্য ও টেক্সটাইলের কর কমায় রপ্তানি প্রতিযোগিতায় ভারত এগিয়ে যাবে।
সমালোচনা ও সীমাবদ্ধতা
রাজস্ব চ্যালেঞ্জ: কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলির রাজস্ব আয় কমার ঝুঁকি রয়েছে প্রাথমিকভাবে।
বাস্তবায়নের জটিলতা: ৪০০+ পণ্যের হার পরিবর্তন ও নতুন শ্রেণীবিভাগ জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।
পেট্রোল-ডিজেল বাদ: জ্বালানির দাম জিএসটির আওতায় না আনায় সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি।
উপসংহার
জিএসটি ২.০ সংস্কার ভারতের কর ব্যবস্থায় একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। যদিও বিরোধী দলগুলি এটিকে “দেরিতে আসা” এবং “অর্ধসিদ্ধ” বলে সমালোচনা করছে, সরকার এটিকে সাধারণ মানুষের জন্য উপকারী বলে দাবি করছে।
মূল সুবিধাসমূহ:
- নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের কর হ্রাস
- মধ্যবিত্তের জন্য মাসিক সাশ্রয়
- শিল্প খাতের বিকাশে সহায়ক
- অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ইতিবাচক প্রভাব
চ্যালেঞ্জসমূহ:
- রাজ্যগুলির রাজস্ব ক্ষতির আশঙ্কা
- বাস্তবায়নের জটিলতা
- রাজনৈতিক বিতর্ক
সার্বিকভাবে এই সংস্কার ভারতের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে আশা করা যাচ্ছে, তবে এর সফলতা নির্ভর করবে সঠিক বাস্তবায়ন এবং রাজ্যগুলির সহযোগিতার উপর। ২২ সেপ্টেম্বর থেকে কার্যকর এই সংস্কার ভারতের কোটি কোটি মানুষের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে।