কন্টেন্ট রাইটার: সাকিল আহমেদ
জ্ঞানই মুক্তির চাবিকাঠি। শিক্ষাই মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে আসে, সৃজনশীল করে, সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু আজকের দিনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন জাগে—যে শিক্ষাব্যবস্থা আমরা অনুসরণ করছি, তা কি সত্যিই আমাদের মুক্তির পথে নিয়ে যাচ্ছে, নাকি এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের অন্ধকূপে ঠেলে দিচ্ছে আগামী প্রজন্মকে?
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ও রোবটিক্স গুণোত্তর হারে উন্নত হচ্ছে। যেসব কাজ মানবশ্রম-নির্ভর ছিল, আজ এআই তা দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করছে। অথচ একটা গোটা প্রজন্ম তাদের সময়, পরিশ্রম ও অর্থ ব্যয় করছে এমন কিছু পেশায় প্রবেশের আশায়, যেগুলো আগামী এক দশকের মধ্যেই বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে।
আমরা এমন এক যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে লক্ষ লক্ষ তরুণ-তরুণী তাদের রাতের ঘুম, বাবা-মায়ের উপার্জিত অর্থ ও জীবন-যৌবনের সোনালী সময় একটি স্থায়ী চাকরির আশায় বিসর্জন দিচ্ছে। কিন্তু কঠোর বাস্তবতা হলো—যতদিনে তারা হয়তো ডিগ্রি অর্জন করবে, ততদিনে সেই চাকরিগুলোর অস্তিত্বই থাকবে না।
আশ্চর্যের বিষয় হলো, শিক্ষাব্যবস্থা ও পাঠ্যক্রম এখনও সেই পুরোনো ধাঁচেই সাজানো, যেখানে মুখস্থভিত্তিক পড়াশোনা ও পরীক্ষাভিত্তিক মূল্যায়নই প্রধান লক্ষ্য । একদিকে যন্ত্র শিখছে (মেশিন লার্নিং), নতুন নতুন দক্ষতা অর্জন করছে বিশ্লেষণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করছে অন্যদিকে মানব শিক্ষার্থীরা কেবল তথ্য গ্রহণ করেই ক্ষান্ত থাকছে।
অনেকে সমস্যাটি সরকারি অবহেলা বা প্রাতিষ্ঠানিক জড়তা বলে আক্ষেপ করে থাকেন । মতান্তরে—এটি আসলে এক পরিকল্পিত ফাঁদ, এক সুপরিকল্পিত নিয়ন্ত্রণ কৌশল। উচ্চশিক্ষা শেষে কর্মসংস্থান না পেয়ে তরুণ সমাজ বাধ্য হবে রাষ্ট্রীয় অনুদান ও কর্পোরেটের শর্তাবলীর উপর নির্ভরশীল হতে, এবং বাধ্য হবে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার দাসত্ব স্বীকার করতে। শিক্ষা তখন আর মুক্তির পথ নয়, বরং নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ারে পরিণত হবে।
যেখানে শিক্ষাব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত ছিল স্বাধীন চিন্তাভাবনা, মানবিকতা ও সৃজনশীলতার বিকাশ, এবং শিক্ষার্থীকে স্বনির্ভর করে তোলার প্রশিক্ষণ। আজ তা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে কেবল নম্বর আর ডিগ্রির প্রতিযোগিতায়। অথচ সেই ডিগ্রি আর নিশ্চিত করতে পারছে না কর্মসংস্থান, আর না দিতে পারছে আত্মমর্যাদার সঙ্গে সমাজে বসবাসের সুযোগ। ফলে শিক্ষিত তরুণ সমাজ ক্রমেই হতাশ, বিভ্রান্ত ও দিশাহীন হয়ে পড়ছে।
উত্তরণের উপায় কী? প্রথমত, শিক্ষাকে আর শুধুমাত্র চাকরি পাওয়ার সিঁড়ি হিসেবে নয়, বরং জীবনযাত্রার দক্ষতা অর্জনের মাধ্যম হিসেবে দেখতে হবে। ক্ষুদ্র উদ্যোগ , ব্যবসা, স্থানীয় পণ্য সম্পদ ব্যবহার করে সাবলম্বিতা অর্জন – এসব পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত। তবে প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের আশায় বসে না থেকে নিজ উদ্যোগে উপার্জনমুখী দক্ষতা অর্জন করতে হবে।
আসন্ন সংকটের ব্যাপারে এখনই সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। শিক্ষা মানে কেবল ডিগ্রি নয়—প্রকৃত মুক্তি আসবে সচেতনতা ও অভিযোজন ক্ষমতা থেকে। শিখতে হবে কীভাবে প্রযুক্তিকে কেবল নির্ভরতার যন্ত্র না বানিয়ে মুক্তির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যায়। আর্থিক স্বাধীনতা ও স্বনির্ভরতা ছাড়া প্রকৃত মুক্তি সম্ভব নয়।
আজকের তরুণ প্রজন্ম সত্যিই এক যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। চিরাচরিত ধারায় চলতে থাকলে এটি নিঃসন্দেহে সর্বনাশের প্রস্তুতি। তবে আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে যদি সচেতন হই এবং শিক্ষার আসল উদ্দেশ্যকে পুনরুদ্ধার করি—স্বনির্ভরতা অর্জনের লক্ষ্যে যুগোপযোগী শিক্ষায় মনোনিবেশ করি, শিক্ষা আবারও মুক্তির পথ হয়ে উঠবে।
2 Comments
যুগোপযোগী একটি বিশ্লেষণধর্মী লেখা। সত্যিই এখন কর্মমুখী শিক্ষার কথা ভাবার সময় এসেছে।
একদম